স্ত্রী রুনু, সঙ্গে দেড় বছরের সন্তান রেহান ও ৯ বছরের রোহান—সবাইকে বেশ অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে গেছেন ৪২ বছর বয়সী কাজী সাইদুর হোসেন। পরপারে চলে গেছেন তিনি গত বুধবার বিকেলে। দুর্ঘটনার পর তাঁর মাথার ভেতরে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। তবে তাঁর হেলমেটটা অক্ষত ছিল। আর হাত-পা সব জায়গা অক্ষত।
বুধবার বিকেল সাড়ে চারটা। ঢাকার হাতিরপুল এলাকার মোতালিব প্লাজা থেকে মুঠোফোন ঠিক করে নাখালপাড়ার বাসার উদ্দেশে যাচ্ছিলেন কাজী সাইদুর হোসেন, স্কুটি চালিয়ে। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ফাঁকা রাস্তার ডান পাশ দিয়ে এগোচ্ছিলেন তিনি। কারওয়ান বাজারে পদচারী–সেতুর নিচে যখন তিনি, তখন গুলিস্তান থেকে আবদুল্লাহপুরগামী একটি বাস পেছন থেকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসে। রাস্তার মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ চলায় স্কুটি নিয়ে সাইদুরের আরও ডান পাশে সরে যাওয়ার জায়গা ছিল না। একপর্যায়ে স্কুটিসহ তিনি রাস্তায় পড়ে যান। তখন বাসের পেছনের চাকা তাঁর মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। তাঁর মৃত্যু নিমেষেই অকূল সমুদ্রে ফেলে দিয়ে যায় একটি পরিবারকে।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত কাজী সাইদুর হোসেনের বড় ভাই কাজী সরোয়ার হোসেনের সঙ্গে আজ সকালে মুঠোফোনে কথা হয় প্রথম আলোর। পুরো পরিবার এখন মাদারীপুরে, নিজ ভিটায় যেখানে গতকাল সকালে চিরনিদ্রায় শায়িত হন সাইদুর।
কথার শুরুতেই দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে কাজী সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘তার (সাইদুর) স্ত্রী ও দুই ছেলে। বড়টা ৭ বছরের, অন্যটা দেড় বছরের। মেয়েটা অল্প বয়সে বিধবা হলো। এই মুহূর্তে দুইটা বাচ্চা নিয়ে ঢাকা শহরে কীভাবে যে থাকবে! কী যে হবে, জানি না। তাদের ভবিষ্যৎই এখন সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে। আমার ভাইটা একাই আয়–রোজগার করত, তার বউ হাউসওয়াইফ (গৃহিণী)।’
বড় ছেলে রোহান বাবার অনুপস্থিতি কিছুটা বুঝতে পারছে। কিন্তু দেড় বছরের ছোট ছেলে রেহান এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। রেহান যখনই তার বাবাকে ডাকছে, তখনই তাকে বলা হচ্ছে, ‘বাবা ফোন আনতে গেছে। চলে আসবে।’ রেহান জানে না, তার বাবা চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
কাজী সাইদুর হোসেনের স্ত্রী রুনুর কথা বলার মতো অবস্থা নেই। কাজী সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের ছয় ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিল সে। কিন্তু চলে গেল সবার আগে।’
পরিবারের ভাষ্যমতে, কাজী সাইদুর হোসেন থাকতেন দুবাইয়ে। সেখানে একটি আবাসিক হোটেলে চাকরি করতেন। গত বছর করোনা মহামারি শুরুর সময়টায় দেশে চলে আসেন। দেশে এসে কিছুদিন ব্যবসা করছিলেন। এখন আবার ভিসার জন্য প্রসেসিং (প্রক্রিয়া) চলছিল।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পাঠানো এক বিবৃতি অনুসারে, দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে সড়কে প্রাণ হারিয়েছে ৩ হাজার ২২২ জন।
দুর্ঘটনার পর বাসটিকে আটক করে পুলিশ। কিন্তু চালক ও সহকারী পালিয়ে যান। সেদিন রাতেই তেজগাঁও থানায় বাদী হয়ে একটি মামলা করেন কাজী সরোয়ার হোসেন। তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেন, দুর্ঘটনায় ভাইয়ের হাত–পা গেলেও বেঁচে তো থাকত। পঙ্গু হলেও সন্তানগুলো বাবাহারা তো হতো না। এখন পরিবারের দাবি, যারা দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা যেন পরিবারের পুরো ভরণ–পোষণের দায়িত্ব নেয়।
শুধু সাইদুর নন, নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) তথ্যমতে, প্রতিদিন দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়ই মারা যাচ্ছে ৭ থেকে ৮ জন। অন্যদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যানে এ বছরের জুন পর্যন্ত গত ৬ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই অবস্থার মধ্য দিয়েই আজ দেশে পালিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস।
আমাদের দেশের সড়কের শোল্ডার, অর্থাৎ পিচের পাশের মাটির অংশটা ঠিক না। গাড়ি চালানোর সময় চাকার একপাশ পাকা অংশে ও অপর পাশ মাটিতে নেমে গেলে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
নিসচার চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন
নিসচার পরিসংখ্যান অনুসারে প্রতিবছর গড়ে পাঁচ হাজার লোক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। ২০২০ সালে কয়েক মাস বিধিনিষেধ ছিল। তারপরও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ৪ হাজার ৯২টি, নিহত হন ৪ হাজর ৯৬৯ জন ও আহত হন ৫ হাজর ৮৫ জন। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৭০২টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫ হজার ২২৭ জন। আর আহত হন ৬ হাজার ৯৫৩ জন।
নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে গণমাধ্যমকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পাঠানো এক বিবৃতি অনুসারে, দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে সড়কে প্রাণ হারিয়েছে ৩ হাজার ২২২ জন। এ সময় ৩ হাজার ৩৭টি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে ৪ হাজার ৮০৫ জন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে একটি গবেষণা করে ২০১৬ সালে। ১৮ বছরের সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করা হয় এখানে। প্রতিষ্ঠানটির সহকারী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ সাইফুল নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার ৮০ শতাংশ ঘটে গাড়ির মাত্রাতিরিক্ত গতি ও বেপরোয়া চালনার কারণে। বাকি ২০ শতাংশ ঘটে অন্যান্য কারণে।
নিসচার চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশের সড়কের শোল্ডার, অর্থাৎ পিচের পাশের মাটির অংশটা ঠিক না। গাড়ি চালানোর সময় চাকার একপাশ পাকা অংশে ও অপর পাশ মাটিতে নেমে গেলে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ থাকে না। অন্যান্য দেশে এ জন্য রাস্তার পাশে রেলিং থাকে। বাংলাদেশে এমনটা নেই।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ওই বছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৫ হাজার। আর সরকারি হিসেবে এ সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৩৭৬।