ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রায় ৪১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। সেই লঞ্চ থেকে বেঁচে ফিরেছেন অনেকে। অনেকই আবার আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সেদিন সেই লঞ্চ অগ্নিকাণ্ড থেকে প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন ই-কমার্স উদ্যোক্তা মেহেরিনা কামাল মুন।
শেষ মুহূর্তে লঞ্চ থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিচে নামেন। সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভয়ংকর সেই দিনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।
বিডি২৪লাইভ-এর পাঠকদের জন্য সেই স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো-
‘অনেকেই জানতে চান। একে একে বলা কোনোভাবেই সম্ভব না। আর বারবার বলা মানেই বারবার ওই মুহূর্তের মধ্যে ঢুকে যাওয়া। এক কথায় যদি বলি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা বা মৃত্যু আসতে দেখা।
২৪ তারিখ রাত তখন আনুমানিক ২.১৫-২০।
আমার ঘুম ভেঙে গেছে এমনিতেই। ওয়াশরুমে গেলাম। এর মধ্যে মেয়েও উঠে বলে, ফিডার দুদু খাবে।
মেয়েকে খাইয়ে মাত্রই শুয়েছি। এরই মধ্যে চিল্লাচিল্লি শুনে রুম থেকে বের হলাম দেখার জন্য। কেবিনের সামনের রেলিং দিয়ে উঁকি দিয়েই দেখি আগুন। এক সেকেন্ডও কোনো কিছু চিন্তা না করে রুমে ঢুকে জাস্ট মোবাইল আর বাচ্চাটা কোলে নিলাম। দৌড়ে গেলাম ৩ তলার একেবারে সামনের দিকে। মাথায় ছিলো খোলা জায়গায় থাকতে হবে। কিন্তু নামবো কিভাবে কোনো পথ পাচ্ছিলাম না। এই টুকু বাচ্চা নিয়ে এই ৩ তলা থেকে পানিতে নামা মানে বাঁচার সম্ভাবনা কমে যাওয়া।
লঞ্চ ঝালকাঠির ঘাটের কিছুটা কাছাকাছি আসার পরে ৪০-৫০ জন পানিতে ঝাঁপ দিয়ে নেমে গেছে। আমরা উপর থেকে সেটাও সাহস করতে পারিনি। আমি বেশি আতঙ্কিত ছিলাম৷ কিভাবে নামবো এই বাচ্চা নিয়ে। ওর বাবা বললো, পানিতে নামা লাগলেও নিচতলা থেকে নামবো। এই বলে সে পরে থাকা জিন্স প্যান্ট খুলে ফেলে। এই সব চলার মধ্যে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে লঞ্চ মাঝ নদীতে চলে আসে। তখন পানিতে নামা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু যতটা কাছ থেকে নামা যায়। এর মধ্যে আমাদের সামনে এক মহিলা নিজের পরার শাড়ি খুলে রেলিংয়ে বেধে নিচের দিকে নেমে যান। সেই শাড়ি ঝুলছিল।
রাজিব ভাবলো ওই শাড়ি দিয়েই নামবে মেয়ে নিয়ে। আমার মাথায় জাস্ট ৫-৭ সেকেন্ডের মধ্যে কাজ করলো যদি বেঁচে যাই তাহলে মোবাইলটা জরুরি। আমি আমার মোবাইলটা ওড়নার এক মাথায় বেঁধে সেই ওড়না দিয়েই মেয়েকে ওর বাবার কোমরে বেঁধে দিলাম। কারণ চিন্তা আসলো হাতে নিয়ে নামলে যে কোনো সময় হাত ছুটে যেতে পারে। এসব করতে করতে তখন আগুন ৩ তলায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি ভয়াবহ কালো ধোঁয়ার মধ্যে আগুনের হল্কা। মেয়ে শ্বাস নিতে পারছিলো না।
মেয়ের বাবা নেমে গেলো। আমিও তার পেছনে পেছনে নামলাম কিন্তু দোতলা পর্যন্ত নেমে সেই শাড়ি শেষ। অন্ধকার, ধোয়ায় রেলিং আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এক লোক এক টানে আমাকে নিচের ফ্লোরে নামিয়ে আনল। এর মধ্যে লঞ্চের অন্য পাশ থেকে লোকজন চিল্লাচ্ছে, ভাই আপনার এদিকে আসেন, এপাশে আসেন এদিকে মাটি আছে। পরে সেই ধোঁয়া, অন্ধকারের মধ্যেই ওপাশে যেয়ে কোনো কিছু না ভেবেই লাফ দিলাম। মনে হলো আল্লাহ জেনো নিজে ঠেলে লঞ্চটা সাইডে নিলো। কাঁদার মধ্যে পা আটকে পা মচকালো। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই। মেয়ের বাবা জাস্ট হাত ধরে মাত্রই দাঁড় করিয়েছে এর মধ্যেই পেছন দিকে এক সিলিন্ডার বাস্ট হয়ে গেলো। জাস্ট ভাবছি, এক-দেড় মিনিট দেরি হলে কি হতো।’
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা ৬টার দিকে প্রায় ৪০০ যাত্রী নিয়ে লঞ্চটি সদরঘাট থেকে বরগুনার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। চাঁদপুর ও বরিশাল টার্মিনালে লঞ্চটি থামে এবং যাত্রী ওঠানামা করে। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে পৌঁছলে রাত ৩টার দিকে এতে আগুন ধরে যায়। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় ৪১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন শতাধিক।